মায়ানমার শুক্রবার, ২৮ মার্চ একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
৭.৭ মাত্রার এই কম্পন দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুভূত হয়েছে, এমনকি থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীনেও।
মায়ানমারের সামরিক সরকারের নেতারা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ৩,০০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে এবং ৪,৫০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। তবে মৃত ও আহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। থাইল্যান্ডেও অন্তত ২১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হলো—
ভূমিকম্প কোথায় আঘাত হেনেছে?
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল সাগাইং শহর থেকে প্রায় ১৬ কিমি (১০ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে।
এই স্থানটি মায়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ম্যান্ডালয়ের কাছাকাছি, যেখানে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বাস — এবং এটি রাজধানী নেইপিডো থেকে প্রায় ২০০ কিমি (১২৫ মাইল) উত্তরে।
USGS অনুযায়ী, প্রথম ভূমিকম্পটি স্থানীয় সময় দুপুর ১২:৫০ মিনিটে (গ্রিনউইচ মান সময় ০৬:২০) আঘাত হানে। এরপর মাত্র ১২ মিনিট পর, ৬.৪ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয় যার কেন্দ্র ছিল সাগাইংয়ের দক্ষিণে ১৮ কিমি দূরে।
ভূমিকম্পের পর থেকে এখনও আফটারশক বা পরাঘাত চলছে — রোববার ম্যান্ডালয়ের উত্তর-পশ্চিমে ৫.১ মাত্রার একটি কম্পন অনুভূত হয়। এক বাসিন্দা বিবিসি বার্মিজকে জানান, ২৮ মার্চের পর এটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পন যা তারা অনুভব করেছেন।
মায়ানমারে (যেটি আগে বার্মা নামে পরিচিত ছিল) শক্তিশালী ভূমিকম্পের ফলে রাস্তাঘাট ফেটে গেছে, সেতুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বহু ভবন ধসে পড়েছে। প্রায় ৫৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিতে ব্যাপক ধ্বংস দেখা গেছে।
এটি বিশ্বের অন্যতম ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি অঞ্চলে — সাগাইং, ম্যান্ডালে, মাগওয়ে, বাগো, শান এবং নেইপিডো — জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
শনিবার শাসক সামরিক জান্তা জানিয়েছে, শুধুমাত্র ম্যান্ডালে অঞ্চলে ১,৫৯১টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়েছে, যাদের উদ্ধারে উদ্ধারকারীরা “নগ্ন হাতে” তল্লাশি চালাচ্ছেন।
ভূমিকম্পের শক্তিশালী কম্পন থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পশ্চিম চীনসহ অন্যান্য এলাকাতেও অনুভূত হয়েছে।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, যা ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে ১,০০০ কিমি (৬২১ মাইল) দূরে অবস্থিত, সেখানেও একটি অসমাপ্ত উচ্চ ভবন এই কম্পনে ধসে পড়ে।
ভিডিওতে দেখা গেছে, ব্যাংককের দোল খাওয়া ভবনগুলোর ছাদের সুইমিং পুলগুলো থেকে পানি ছড়িয়ে পড়ছে।
এই ভূমিকম্প কতটা প্রাণঘাতী ছিল?
মায়ানমারে সরকারিভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এখন ৩,০০০ ছাড়িয়ে গেছে, তবে ধারণা করা হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া আরও বহু মানুষকে উদ্ধার করা গেলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে ম্যান্ডালে অঞ্চলে।
সামরিক সরকারের বরাতে জানা গেছে, ৪,৭০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন এবং অন্তত ৩৪১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। উদ্ধার তৎপরতা এখনও চলছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার মডেল অনুসারে, মায়ানমারে মৃত্যুর সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং ক্ষতির পরিমাণ বার্ষিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের চেয়েও বেশি হতে পারে।
এদিকে ব্যাংককে এখন পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে — যাদের মধ্যে ১৪ জন ধসে পড়া ওই উচ্চ ভবনে ছিলেন, যেখানে এখনও বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।
মায়ানমারের পরিস্থিতি জানা এত কঠিন কেন?
মায়ানারের বাস্তব পরিস্থিতি জানা অত্যন্ত কঠিন, আর এটাই অন্যতম কারণ যে এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটি সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যারা অতীতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকৃত মাত্রা গোপন করার ইতিহাস রাখে।
রাষ্ট্রীয় সরকার স্থানীয় রেডিও, টেলিভিশন, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্টারনেট ব্যবহারে রয়েছে কঠোর সীমাবদ্ধতা।
প্রভাবিত এলাকাগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, আর হাজার হাজার মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে, যার ফলে বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর পক্ষে স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিদেশি সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
ভূমিকম্পের পর পরিস্থিতি কাভার করতে চাওয়া বিদেশি সাংবাদিকদের ভিসা দেওয়া হবে না বলে জান্তা সরকার জানিয়েছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় এই কারণ দেখিয়ে।
সংঘাত কীভাবে ত্রাণকার্যে প্রভাব ফেলছে?
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে গণবিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরে গণতন্ত্রপন্থী এবং জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত প্রতিরোধে রূপ নেয় — যার ফলশ্রুতিতে এখন মায়ানমারে কার্যত একটি গৃহযুদ্ধ চলছে।
ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র সাগাইং অঞ্চলের বড় একটি অংশ এখন গণতন্ত্রপন্থী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে শহরাঞ্চলে — যেমন ম্যান্ডালে, নেইপিডো এবং ইয়াঙ্গুন — জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেশি।
প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিনিধিত্বকারী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (NUG) জানিয়েছে, তাদের সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (PDF) ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৩০ মার্চ থেকে দুই সপ্তাহের জন্য আক্রমণাত্মক অভিযান স্থগিত রেখেছে, শুধুমাত্র আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ বাদে।
PDF বাহিনী ২০২১ সাল থেকে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
তবে এই বিরতির কতটা প্রভাব পড়বে তা স্পষ্ট নয়, কারণ বহু জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী NUG-এর নির্দেশনায় চলে না।
এরই মধ্যে, জান্তা বাহিনী কিছু এলাকায় বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে, যেগুলো জাতিসংঘ “চূড়ান্তভাবে অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য” বলে নিন্দা জানিয়েছে।
ভূমিকম্প কেন হয়?
পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ মূলত বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত — যেগুলোকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো একে অপরের পাশে পাশাপাশি বসে থাকে।
এই প্লেটগুলো প্রায়ই নড়াচড়া করার চেষ্টা করে, কিন্তু পাশাপাশি থাকা অন্য প্লেটের সাথে ঘর্ষণের কারণে তা সম্ভব হয় না।
কিন্তু একসময় এই চাপ এতটাই বেড়ে যায় যে, একটি প্লেট হঠাৎ করে ধাক্কা খেয়ে সরে যায় — তখনই ভূ-পৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে এবং ভূমিকম্প ঘটে।
ভূমিকম্পের মাত্রা Moment Magnitude Scale (Mw)-এ পরিমাপ করা হয়, যা পুরনো রিকটার স্কেল-এর জায়গা নিয়েছে কারণ এটি আরও আধুনিক ও নির্ভুল।
একটি ভূমিকম্পের স্কেল নম্বর বোঝায় — ভূগর্ভস্থ ফাটলের কতটা অংশ সরে গেছে এবং তা কতটা শক্তিতে সরে গেছে, এই দুইয়ের সম্মিলিত হিসাব।
-
২.৫ বা তার নিচের কম্পন সাধারণত মানুষ অনুভব করতে পারে না, তবে যন্ত্রের মাধ্যমে ধরা যায়।
-
৫.০ পর্যন্ত ভূমিকম্প অনুভব করা যায় এবং সাধারণত সামান্য ক্ষতি করে।
-
মায়ানমারের ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প একটি মেজর (গুরুতর) ভূমিকম্প হিসেবে বিবেচিত, এবং এটি সাধারণত ভয়াবহ ক্ষতি ঘটায় — যেমনটি এবারের ঘটনায় হয়েছে।
-
৮.০ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ধ্বংসাত্মক হয় এবং কেন্দ্রস্থলের আশেপাশের সম্পূর্ণ জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারে।